১ম পর্ব
আমার নাম তুশি সারোয়ার। আমি বাংলাদেশি, তবে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় থাকি কারণ আমার স্বামী আলম সারোয়ার সিডনীতে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে জব করেন। আমি, আমার স্বামী, আর আমাদের ৪ বছরের ছোট্ট সন্তান এই নিয়ে সিডনীর একটি এপার্টমেন্টে আমাদের ছোট্ট সুখের সংসার। আমদের বিয়ে হয়েছে ৬ বছর হল। বিয়ের পরই আমার শ্বশুর-শাশুড়ি অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল এটা ঠিক হবেনা। কারণ আমার শ্বশুর-শাশুড়ির একমাত্র ছেলের বউ আমি। বিয়ের পরপরই যদি চলে আসি সেটা খারাপ দেখায়। তাই আমি বিয়ের পর ৪ বছর বাংলাদেশেই শ্বশুর-শাশুরির সাথে ছিলাম। আলম এসময় অস্ট্রেলিয়ায় ছিল। তবে ও ছুটি পেলেই বাংলাদেশে চলে যেত। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আমাকে খুবই ভালবাসেন, কারণ তাদের কোনো মেয়ে নেই। আমার স্বামীই তাদের একমাত্র সন্তান। তাঁরা বলেন যে আমাকে পেয়ে নাকি তাদের মেয়ের অভাব ঘুচে গেছে। আমার স্বামী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বামী। আমাকে ও খুব ভালবাসে। আমিও ওকে খুব ভালবাসি। আমি যখন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন আলমের সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়। আলম তখন বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে জব করছে অস্ট্রেলিয়ায়। অবশ্য এর আগে বাংলাদেশে দু’ বছর জব করেছে। আলমদের তুলনায় আমরা গরিবই ছিলাম। কারণ, আমার শ্বশুরের ঢাকায় চারতলা বাড়ি, মিরপুরে দুইটা দোকান আর গ্রামেও অনেক সম্পত্তি। সে তুলনায় আমার আব্বা কিছুইনা, একজন সরকারি চাকুরীজীবী মাত্র। আমরা থাকতাম মফস্বল এলাকায়, শহরের শেষ মাথায়, অনেকটা গ্রামের মতই। আমি আলমের তুলনায় কম শিক্ষিত বা একটু গেঁয়ো টাইপের হলেও ও আমাকে কোনোদিন অবহেলা করেনি। আমাদের এরেঞ্জড ম্যারেজ হলেও, আমরা দু’জনেই খুব খুশি। আমার বর্তমান বয়স ২৯ এবং আলমের বয়স ৩৬ বছর। যাইহোক বিয়ের দুই বছর পরই আমাদের কোল জুড়ে এল আমাদের সন্তান, চোখের মাণিক, আমাদের ছেলে রাফিন। ওর জন্মের পর আমাদের সুখ যেন আরো বেড়ে গেল। আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি তো ওকে ছাড়া কিছুই বুঝেননা। রাফিনের যখন বছর আড়াই এর মত হল, তখন আমার শ্বশুর আবার বললেন, “বউমা, এবার তুমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাও। রাফিন বড় হচ্ছে।” শেষ পর্যন্ত আমি আর রাফিন চলে আসি সিডনীতে। এখানে শুরু হয়, আমাদের নতুন জীবন, নতুন সংসার। আলম সকালে যায়, বিকালে ফেরে। আমি আর রাফিন বাসায় থাকি। রাফিনকে দেখাশুনা করি, ঘরের কাজকর্ম করি, রান্নাবান্না করি। এভাবেই ভালভাবে দিন কেটে যাচ্ছে। রবিবারে সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় আমরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাই। হঠাৎ একদিন বাংলাদেশ থেকে খবর এল যে আমার শ্বশুর গুরুতর অসুস্থ, আমরা যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশে চলে যাই। আলম ঐদিনই সব ব্যবস্থা করল। প্লেনের টিকিট কাটল। কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিল। আমার ভিসায় কি জানি প্রবলেম হয়েছিল, তাই আমার পাসপোর্ট বাংলাদেশ হাইকমিশনে ছিল। আলম সেগুলো আনতে গেল। কিন্তু হাইকমিশন থেকে জানাল যে, কমপক্ষে দু’দিন লাগবে। এর আগে পাসপোর্ট দেওয়া সম্ভব নয় কোনোভাবেই। আলম খুব রেগে গেল। সেখানকার লোকজনের সাথে কথা কাটাকাটি হল। আলম অনেক জায়গায় ফোন করে কিছু করা যায় কিনা চেষ্টা করল। কিন্তু লাভ হলনা। শেষে সিদ্ধান্ত হল, আলম একাই বাংলাদেশে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে সবাই বলল, বাবা মানে আমার শ্বশুর রাফিনকে দেখতে চেয়েছেন, তাই রাফিনকে যাতে অবশ্যই নিয়ে যাওয়া হয়। আমি প্রথমে রাজি হলাম না। ৩ বছরের একটা বাচ্চা, যে কোনোদিন মা ছাড়া থাকেনি তাকে কিভাবে আমি যেতে দিব? কিন্তু পরে আলম আমাকে বোঝাল, যে বাবার অবস্থা ভালনা, কখন কি হয়ে যায় বলা যায়না। তার একমাত্র নাতি হল রাফিন। তাই রাফিনিকে এখন না নিয়ে গেলে বাবার কিছু হয়ে গেলে তার একটা অপূর্ণতা থেকে যাবে, আর লোকজনও খারাপ বলবে। শেষমেশ আমি রাজি হলাম। আলম আমকে একা রেখে যাওয়ায় কিছুটা চিন্তিত ছিল।ও আমাকে বলল,” তুমি চিন্তা করোনা। এখান থেকে বাবার জন্য দোয়া কর। আর রাফিনের জন্য ভেবোনা, আমিতো ওর সাথেই আছি। আর বাইরে কোথাও বের হওয়ার দরকার নেই। বাজার-সদাইতো ফ্রিজে আছেই। তাছাড়া তুমি এখানকার পথঘাট ভাল করে চেননা, আবার ভাল ইংরেজিও বলত্র পারনা।” আমি আলমের হাত ধরে বললাম,”তুমি চিন্তা করোনা। আমি থাকতে পারব। ” আলম আমাকে কয়েকটি ফোন নাম্বার দিয়ে গেল এখানকার কিছু বাংলাদেশির। যদি কোনো প্রয়োজন বা বিপদ হয় তাহলে যোগাযোগ করার জন্য। তাছাড়া দুইদিন পরের প্লেনের টিকিটও কেটে আমাকে দিয়ে গেল। যদি কোনো খারাপ খবর আসে বাংলাদেশ থেকে তাহলে আমি নিজেই চলে যেতে পারব হাইকমিশন থেকে পাসপোর্ট উঠিয়ে। আমি আলম ও রাফিনকে সন্ধায় বিদায় দিলাম। ওরা ট্যাক্সিতে করে এয়ারপোর্ট চলে গেল। সন্ধ্যা ৭ টায় ফ্লাইট। রাফিনকে বিদায় দিতে আমার কান্না চলে আসছিল। পরে নিজেকে সামলে নিলাম। আমি যদি কাঁদি রাফিনও কেঁদে ফেলবে, তাছাড়া আলমের মনটাও ভেঙে যাবে। ঐদিন রাতে আমার আর ঘুম হলনা। আদরের ছেলেকে ছাড়া কিছুই যেন ভাল লাগছেনা। এই প্রথমবার রাফিন আমার কাছ থেকে এত দূরে গেল। আমি একা একটা মেয়ে এই বিদেশে একটা এপার্টমেন্টে একা পড়ে আছি। আমার শ্বশুর মৃতুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন, আমি তাকে দেখতে যেতে পারলামনা। যে মানুষটা আমাকে এত ভালবাসেন, নিজের মেয়ের মত, তাঁর অসুস্থতার সময় পাশে থাকতে পারলামনা। বাংলাদেশ হাইকমিশিনের উপর খুব রাগ হল। বাঙালীর দায়ছাড়া ভাবটা এই বিদেশে এসেও গেলনা। কত আগে কাগজপত্র জমা দিয়েছি তারা এখনো সেই কাগজ ধরেওনি। আলম ও রাফিন সকাল ৭টায় ঢাকায় পৌঁছাল। পৌঁছেই আমাকে ফোন করল। তারা ভালভাবে গিয়েছে। রাফিনও ভাল আছে। সবচেয়ে ভাল খবর হল, আমার শ্বশুর আগের চেয়ে সুস্থ আছেন। এখন কথা বলতে পারছেন, উঠে বসেছেন এবং ভাতও খেয়েছেন। আমি রাফিনের সাথে কথা বললাম। ও খুব খুশি, বলল যে দাদার সঙ্গে খেলা করছে। আলম জানতে চাইল কোনো সমস্যা আছে কিনা? আমি বললাম যে কোনো সমস্যা নেই, আমি ভাল আছি। আমার শ্বশুরের সাথেও কথা বললাম। তারপর আমার শাশুড়িও ফোনে কথা বললেন। তিনি বললেন আমি যাতে চিন্তা না করি রাফিনের জন্য। আমার আব্বা-আম্মাও আমার শ্বশুরের অসুস্থতার খবর পেয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকায় এসেছেন। আব্বা-আম্মা দু’জনের সাথেই কথা বললাম। আমার চিন্তা একেবারেই দূর হয়ে গেল।রাফিনের দাদা-দাদী, নানা-নানী, বাবা সবাই আছে সেখানে। তারা রাফিনকে আমার অনুপস্থিতি বুঝতেই দিবেননা। আর বাংলাদেশে থাকতে রাফিন সারাক্ষণ দাদীর কাছে বা নানীর কাছে মানে আমার আম্মার কাছেই থাকত। তাই আমি আরও নিশ্চিন্ত হলাম। তাছাড়া আমার শ্বশুরের শারীরিক অবস্থাও এখন আগের চেয়ে বেশ ভাল। আলম বলল বাবার অবস্থা ভাল থাকলে সে চলে আসবে। আমাকে চিন্তা করতে মানা করল। আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে সকালের নাস্তা করলাম, ঘর গুছালাম। তারপর আমার শ্বশুরের সুস্থতা কামনা করে নফল নামায পড়লাম। এরপর টিভি ছেড়ে সোফায় বসলাম।.....
২য় পর্ব পরতে এখানে ক্লিক করুন
৩য় পর্ব পরতে এখানে ক্লিক করুন